গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরম, অসহনীয় তাপমাত্রার আর টানা বৃষ্টিপাতের অভাবের কারনে সবখানেই মানুষের মাঝে এখন অস্বস্তি ! নভিশ্বাস। এই নাভিশ্বাস আরও বাড়িয়ে তুলেছে খাবার পানির তীব্র সংকট।
দক্ষিণের জেলা হওয়াতে বাগেরহাটে লবন পানির প্রভাব বরাবরই। আর সাম্প্রতিক কয়েক বছরে প্রকৃতির খেয়ালীপনা আর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের কারনে দিনে দিনে পানি সংকট যেন তীব্র থেকে তিব্র তর হচ্ছে এ জেলায়।
পারিতে লবনক্তার সাথে সাথে শহর অঞ্চলে জলাশয়-জলাধার ভরাট, উৎস স্থল গুলোতে পানি দূষণের পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাওয়া এবং আরসেনিকের কারণে নলকুপের পানি হয়ে পড়ছে ব্যবহার অনউপযোগী আর অনেক স্থানে পুকুর গুলোতে দেখা দিচ্ছে পানি স্বল্পতা।
এসব নানা কারনে জেলা শহরসহ বাগেরহাটের প্রায় সব উপজেলাতেই এখন খাবর পানির তীব্র সংকট। পৌরসভা এবং কিছু কিছু এলাকায় সাপ্লাই এর মাধ্যমে পানি সর্বারাহের ব্যাবস্থা থাকলেও গ্রীষ্ম মৌসুমের চাহিদার তুলোনায় তা অনেক কম।
আর বাস্তবতা হল বাগেরহাট পৌরসভার অনেক পানির গ্রাহক বর্তমানে সাপ্লাই পানির লাইনের পাইপ নিচু করে মাটিতে গর্ভীর গর্ত করেও ঠিক মতন পানি পাচ্ছেন না।
জেলা ও উপজেলা শহর গুলো ছাড়াও বর্তমানে সুন্দরবন সংলগ্ন মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল ও মংলায় পানি সংকট সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে মোরেলগঞ্জ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নসহ পৌর এলাকায় খাবার পানির এ সংকট ভয়াবহতায় রূপ নিয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে নলকুপে আর্সেনিক, অকেজো নলকুপ ও পিএসএফ এবং গভীর নলকুপের সংকটের কারেন প্রকট হচ্ছে পানি স্বল্পতা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নের অধিকাংশ সরকারি নলকুপ ও পিএসএফ (পুকুরের পানি শোধন প্লান্ট) অকেজো। পাশাপশি বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে নির্মিত শত শত নলকুপও অকেজো হয়ে পড়ে আছে। মোড়েলগঞ্জ পৌর সদরে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকায় পৌরবাসী বিশুদ্ধ পানির অভাবে অভাবনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। উপজেলার ৩০৪ টি সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশতে কোন টিউবওয়েল নেই।
আর যেগুলোতে আছে তাও বেশির ভাগ খুচরা যন্ত্রাংশ ও তত্ত্বাবধায়নের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। শত শত নলকুপের যন্ত্রাংশ ইতোপূর্বে চুরি হয়ে গেছে।
উপজেলার ১৬ টি ইউনিয়নে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিউধরা, নিশানবাড়ীয়া, খাউলিয়া, বলইবুনিয়াসহ অধিকাংশ ইউনিয়নে এ মৌসুমে পানিতে অতিরিক্ত লবনাক্তার কারণে পুকুরের পানি পান করতে পারছে না এলাকাবাসী।
অপরদিকে পুকুরের পানি শুকিয়ে যাবার কারনে প্রতিটি গ্রামের বাসিন্দারা দূর দূরন্ত থেকে মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে, নৌকায় চড়ে খাবার পানি সংগ্রহ করছে। অনেক বাধ্য হয়ে পন করছেন খোলা পুকুর খাল ও নদী নালার পানি।
সদর ইউনিয়ন ও পৌরবাসীকে খাবার পানির জন্য একমাত্র থানার পুকুরের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাও বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে গেছে। সকাল থেকে রাতভর এপুকুর থেকে সমান ভাবে পানি নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও পৌর সদরের কুঠিবাড়ি, এসএম কলেজ পুকুর থেকে ময়লাযুক্ত পানি হোটেল ও রেষ্টুরেন্টে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ কারনে বিভিন্ন পানি বাহীত রোগ, পেটের পীড়াসহ নানা রোগে ভুগছে শিশুসহ লোকজন। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মোড়েলগঞ্জ সদর হাসপাতালের রোগীদের মধ্যে হাহাকার চলছে। হাসপাতালের একটি পুকুর শুকনো, পিএসএফ নষ্ট। রোগীদের ভরসা নদীর পানি। নদীর পানি পান করে তারা আরো রোগাগ্রস্থ হচ্ছে বলে রোগীরা জানায়।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস সূত্রে জানাগেছে, উপজেলার ১৬ ইউনিয়নের সরকারিভাবে ৪৮ টি ও বেসরকারিভাবে ১৬ শ’ পাণীয় জলের পুকুর রয়েছে। পিএসএফ রয়েছে ৭৬০। এর মধ্যে ২৬০ টি চালু রয়েছে। অকেজো রয়েছে ৫ শতাধিক। ১০টি গভীর নলকুপের মধ্যে জিউধরা ইউনিয়নে একটি চালু রয়েছে।
এছাড়া রেইন ওয়াটার হারবেষ্ট্রিং প্লান্ট রয়েছে ৮০টি। সদর ইউনিয়নের ভাইজোড়া গ্রামে চালু রয়েছে একটি রিংওয়েল (পাত কুয়া)। স্যালো টিউবয়েল রয়েছে ৩ হাজার ৬ শ’ ৭০ টি। ১০ বছর পূর্বের জরিপ অনুযায়ী স্যালো টিউবয়েল অকেজো রয়েছে ২ হাজার। পঞ্চকরণ ইউনিয়নে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের কথা থাকলেও তার কোন হদিস নাই।
উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী জানান, ১৬ ইউনিয়নে আর্সেনিক জরিপ কার্যক্রম চলছে। এ জরিপ শেষ হতে মে মাস পর্যন্ত সময় লাগবে । ২০০৩ সালের আর্সিনিক জরিপ অনুযায়ী উপজেলা সব ইউনিয়নে কম বেশী আর্সেনিক চিহিৃত টিউবওয়েল রয়েছে। তবে বনগ্রাম, হোগলাবুনিয়া, হোগলাপাশা ইউনিয়নের আর্সেনিক চিহিৃত টিউবওয়েল রয়েছে সবচেয়ে বেশি ও ভয়ানক আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে।
তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী দপ্তরের এ হিসাবের সাথে ব্যস্তবতার মিল খুবই ক্ষণ। মাইলের পর মাইল হাটলেও দু’ একটি ছাড়া কোন সচল টিউবওয়েল দেখা যায়না। পৌর সদরের চিত্রও প্রায় একই। যেসব টিউবওয়েল সচল রয়েছে থালা বাসন ধোঁয়া ছাড়া পানের অযোগ্য।
সর্বপরি গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহের ফলে জনজীবনে যে ক্লান্তির ছায়া নেমে এসে তীব্র পানি সংকটের ফলে তা এখন আরও দুর্বিসহ করে তুলছে এঅঞ্চলে মানুষের জনজীবণ।