সত্যি অসম্ভব বিষয়! আসলে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না! গাছড়ার গুনে পিঠে বরশি বিধে শূণে ঘোরে মানুষ!
বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার সাইনবোর্ড বাজারের ব্যবসায়ী বাপী দেবনাথের কাছে এমন কথা শুনে গেলাম দেখতে। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ ১৪২১।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে এ উপজেলার শিবপুরে দেখলাম, পিঠে বরশি বিধে মানুষ ঘোরানোর ব্যতিক্রমী ‘চরক’ অনুষ্ঠান। আয়োজকরা জানালেন, গত ৭ বছর ধরে শিবমন্দির মাঠে হয়ে আসছে এ চরক অনুষ্ঠান।
বেলা ৩ টার পর মূল অনুষ্ঠান শুরু হলেও আয়োজনকে কেন্দ্র করে মন্দির মাঠে সকাল থেকে ভিড় জমতে থাকে দেশ-বিদেশের অসংখ্য দর্শনার্থীর।
শিবমন্দিরে প্রার্থনা করে সবাই চরক খেলার মাঠে অপেক্ষা করে, দেখতে থাকেন খেলার পূর্ব পুস্তুতি।
খেলা দেখানোর জন্য মাটিতে পোতা গাছের কাছে এসে প্রার্থনা করেন খেলোযাররা। এরপর দলের অন্য সদস্যরা মূল খেলোয়ারদের মাঠে শুইয়ে রেখে, পিঠে সিদুর দেয়ার পর বরশি ফোটায়। কিন্তু নূন্যতম রক্তও বের হয় না সেখান থেকে। বরশি গায়ে দিয়ে নাচতে থাকে তারা।
লাল কাপড় যায় দর্শনার্থীদের কাছে। দর্শনার্থীরা সামর্থ মত পূর্ণের আশায় লাল কাপড়ে টাকা দেয়। টাকা আদায় শেষে একপর্যায়ে দড়ির সাথে বরশি বেধে শুরু হয় শূণ্যে ঘুরানো।
ঘোরা অবস্থায় খেলোয়ার বাতাসা ছড়াতে থাকে। আর উপস্থিত দর্শনার্থীরা তা পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভেবে নেয়। দশ মিনিট করে এভাবে ঘোরানো হয় মোট দু’জন কে।
ঝুকিপূর্ণ এই খেলা দেখায় ৫ সদস্যর একটি দল। কথা বলে জানা যায়, পার্শবর্তি জেলা গোপালগঞ্জে তাদের বাড়ি। মনের আনন্দে এবং পূর্ণের আশার ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেন খেলোয়াররা।
এ দিন মুল খেলা দেখান গোপলগঞ্জের সদর উপজেলার ঠুঠাভাঙ্গা গ্রামের রাধাকান্ত রায়ের ছেলে সজীব রায় (১৮) ও একই গ্রামের বাবুরাম বিশ্বাসের ছেলে রিপন বিশ্বাস (১৯)।
খেলোয়ার সজীব রায় ও রিপন বিশ্বাস এই প্রতিবেদককে জানান, পিঠে বরশি ঢুকানের পরও তারা কোন ব্যাথা পান না। এতে কোন ভয়ও লাগে না তাদের।
গোপালগঞ্জে ৫ সদস্যর একটি দল এ খেলা দেখায়। মনের আনন্দে এবং পূর্ণের আশার ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেন খেলোয়াররা। এ দিন মুল খেলা দেখান গোপলগঞ্জের সদর উপজেলার ঠুঠাভাঙ্গা গ্রামের রাধাকান্ত রায়ের ছেলে সজীব রায়(১৮) ও একই গ্রামের বাবুরাম বিশ্বাসের ছেলে রিপন বিশ্বাস(১৯)।
তারা আরো বলেন, এটা এক ধরনের সাধনা। গুরুর কাছ থেকে এ খেলা তারা শিখেছেন। টাকা-পয়সার জন্য তারা এ খেলা দেখান না। তারা শুধু পূণ্যের আশায় এবং মনের আনন্দে দর্শনার্থীদের আনন্দ দেয়ার জন্য এ খেলা দেখান। তাদের ধারণা শিব মন্দিরের কাছে এ ধরনের খেলায় শিববাবা তাদের উপর খুশি হলেও হতে পারেন।
সজীব রায় ও রিপন বিশ্বাসের গুরু বিনয় মন্ডল বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন এটা একটি গাছড়ার গুন। যার কারণে রক্ত বের হয়। ব্যাথা অনুভূত হয় না।
সজীব রায় ও রিপন বিশ্বাস-এর হাতে বাঁধা গাছড়াও তিনি এসয় এ প্রতিবেদককে দেখান।
তিনি আরো জানান, একেক জন খেলোয়ার জীবনে মাত্র ৭ বার এই খেলায় অংশ নিতে পারে।
খেলা আয়োজক কমিটির সদস্য রবীন্দ্রনাথ দেবনাথ বাগেরহাট ইনফোকে জানান, ৬’শ বছর আগে খানজাহান আলীর দিঘি খননেন সময় খানজাহান আলী একটি শিবমূর্তি পান। ওই সময় দিঘির পাশ দিয়ে বর্তমান কচুয়া উপজেলার চরকাঠি গ্রামের মহেষ চক্রবর্ত্তী নামের এক ব্রাহ্মণ যাচ্ছিলেন। তাকে ডেকে খানজাহান আলী মূর্তিটি দেন।
মূর্তিটি নিয়ে সে বাড়ির দিকে রওনা হয়। বর্তমানে যেখানে শিবমূতিটি আছে, সেখানে রেখে মহেশ চক্রবর্ত্তী প্রকৃতির ডাকে সাড়ে দিতে যান। এরপর তিনি ফিরে আসলে মূতিটি ওখানে রাখার জন্য দৈব্য বানী আসে। মহেশ চক্রবর্ত্তী মূতিটি ওখানে রেখে পুজা শুরু করেন। তখন থেকে প্রতি বছর এখানে শিবপুজা হয়ে আসছে এবং চরক পুজারও প্রচলন শুরু হয়।
তিনি আরো জানান, অনেকদিন বন্ধ থাকার পর গত ৭ বছর ধরে আবার আমরা চরক পুজার প্রচলন শুরু করেছি। হিন্দু মুসলমান জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অনেকে এখানে আসে।
চরক পুজা দেখতে আসা দর্শনার্থী নাসিমা আকতার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, গত তিন বছর ধরে পহেলা বৈশাখে তিনি পরিবারের সাবইকে নিয়ে এখানে আসেন। খেলাটি তিনি বেশ উপভোগ করেন।
প্রায় একই রকম অনুভুতি এই চরক খেলা দেখতে আসা আর এক দর্শনার্থী রাসেল আহম্মেদর। তিনি জানান, বহুদিন এই খেলার কাথা শুনেরছি। এই প্রথম দেখার সৌভাগ্য হলো। আমি এই খেলা দেখতে পেরে সত্যি আনন্দিত। অপর দিকে দেরিতে আসার জন্য খেলা দেখতে না পেরে আক্ষেপ করে চলে যান অনেকে।
তবে, জন সমুখে এধরণের ঝুকি পূর্ণ খেলা দেখান কতটা যুক্তি যুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন এলাকার স্বচেতন মানুষের।